মোগল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন লালবাগ কেল্লায়

ছুটির দিনের বিকেলে বেড়িয়ে আসতে পারেন মোগল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লায়। কর্মব্যস্ত রাজধানীতে ছুটির দিনে ঘোরার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর হয়না।
সাপ্তাহিক ছুটি রোববার ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য কেল্লা উন্মুক্ত থাকে। মোগল আমলে নির্মিত মনোরম ও আকর্ষণীয় কেল্লার প্রাসাদ ছাড়াও এখানে রয়েছে পরীবিবির মাজার, যা বাংলাদেশের একটি দুর্লভ স্থা্পত্য কীর্তি। মাজারের চারদিকে তিনটি করে দরজা রয়েছে।
মাজারটি নির্মাণে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মীয় স্থাপত্যের এক অপরূপ সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। মাজারটির জন্য উত্তর ভারতের রাজমহল থেকে কালোপাথর, চুনার থেকে বেলেপাথর ও জয়পুর থেকে সাদা মার্বেল পাথর সংগৃহীত হয়েছিল। পাথরের প্রান্তগুলো খোদাই করা ফুল-পাতায় অলংকৃত।
লালবাগ কেল্লার নির্মাণ ইতিহাস
প্রথমে এই কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। আর এই কেল্লার নকশা করেন শাহ আজম। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর ৩য় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। মাত্র এক বছর পরেই দুর্গের নির্মাণকাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরঙগজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়।নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ সালে ঢাকায় এসে পুনরায় দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর এ দুর্গ অপয়া মনে করা হয় এবং শায়েস্তা খান ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণ বন্ধ করে দেন।
এই পরী বিবির সাথে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে রাজকাজ পরিচালনা করতেন। ১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যাবার সময় দুর্গের মালিকানা উত্তরাধিকারীদের দান করে যান। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নানা কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে থাকে।
১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের উন্নয়ন কাজ শুরু করে। এ সময় দুর্গটি লালবাগ দুর্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগ দুর্গের প্রাচীর সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ দুর্গের যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
কি দেখতে পাবেন
কেল্লার অভ্যন্তরে রয়েছে একটি হাম্মামখানা বা গোসলখানা, দরবার হল, মাটির প্লাটফরম, ঝর্ণা, জলাধারা, তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মসজিদের ছাদে তিনটি গম্বুজের গোড়ার অংশ অষ্টকোণাকৃতি ড্রামের আকারের এবং পাতার নকশায় অলংকৃত। এতে রয়েছে পাড় বাঁধানো একটি পুকুর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নির্মিত জাদুঘর।
কেল্লার উত্তর-দক্ষিণে অবস্থিত প্রধান ফটক, উত্তর তোরণ, পশ্চিম তোরণ ও তিনতলাবিশিষ্ট আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন হচ্ছে দক্ষিণ তোরণ। তোরণের সম্মুখে দু’পাশে তিনধাপে উপরে উঠেছে। প্রথম ধাপ একটি অর্ধগম্বুজ ছাদবিশিষ্ট আস্তরে তৈরি প্যানেল দ্বারা অলংকৃত। দরবার হলকে জাদুঘর হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়। জাদুঘরে রয়েছে মোগল আমলের অস্ত্রশস্ত্র, পান্ডুলিপি, মুদ্রা, মৃৎশিল্প, কার্পেট, চিত্র, হস্তলিপি ও রাজকীয় ফরমান।
দর্শনার্থীর ভিড়
মোগল আমলের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন ঢাকার লালবাগ কেল্লায় দর্শনার্থীর সমাগম দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইতিহাসের সাক্ষী এ কেল্লা প্রতিদিনই হাজার হাজার দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। কর্তৃপক্ষের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিবছর এখানে গড়ে প্রায় ৩০ লাখ দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। প্রতিদিন লালবাগ কেল্লা দেখতে আসে দেশি-বিদেশি প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী। এর মধ্যে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও সাধারণ দর্শনার্থী রয়েছে। বিদেশি দর্শনার্থীরা এখানে কেল্লার ইতিহাস জানতে আসেন। সাধারণ দর্শনার্থী ১০ টাকা এবং বিদেশি দর্শনার্থীদের প্রবেশ ফি ১০০ টাকা নেয়া হয়। বার্ষিক টিকিট বিক্রির আয় সাড়ে ৩ কোটি টাকা।
লালবাগ কেল্লার সময়সূচী
লালবাগ দুর্গের গ্রীষ্মকালীন (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) সময়সূচি হলো— সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। আর শীতকালীন (অক্টোবর থেকে মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা। মাঝে ১টা থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যাহ্ন বিরতি। শুক্রবারে মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ২টা ৩০ মিটিন পর্যন্ত। রোববার পূর্ণ দিবস, সোমবার অর্ধ দিবস এবং সব সরকারি ছুটির দিনগুলোতে লালবাগ দুর্গ বন্ধ থাকে।

No comments:

Post a Comment

Adbox